বুধবার , ০৭ মে, ২০২৫ | ২৪ বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ০৬:৩০ ৬ মে ২০২৫
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নারীদের ভূমিকা যতটা আলোচিত হয়, তার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে কিছু নারীর পেছনের অদৃশ্য শক্তি, যাদের নেতৃত্বের প্রভাব কখনো সরাসরি দৃশ্যমান নয়, তবে তাদের উপস্থিতি বা পরোক্ষ সহযোগিতা দেশের রাজনৈতিক মহলে গভীর প্রভাব ফেলে। ডা. জোবাইদা রহমান এমনই একজন ব্যতিক্রমী নারী। একজন চিকিৎসক হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতি, পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি শক্তিশালী পরিবারের সদস্য—তিনি বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক সম্ভাবনার এক নতুন মুখ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। যদিও এখনো সরাসরি রাজনীতিতে প্রবেশ করেননি, তবে তার নাম প্রায়ই রাজনৈতিক আলোচনায় উঠে আসে। তাঁর জীবনযাত্রা, শিক্ষা, পেশা এবং রাজনীতিতে আসার সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত--
চিকিৎসক থেকে রাজনৈতিক সম্ভাবনায়: এক নজরে জোবাইদা রহমান
ডা. জোবাইদা রহমানের জন্ম ১৯৭২ সালের ১৮ জুন সিলেটে। তার পিতা, রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খান, বাংলাদেশের সাবেক নৌবাহিনী প্রধান ছিলেন এবং তার পরিবার একটি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান বজায় রেখেছে। জোবাইদা রহমানের শিরোনামে একটি বিশেষত্ব রয়েছে—তিনি জেনারেল এম এ জি ওসমানীর আত্মীয়, যিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একটি অনস্বীকার্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই সমস্ত পারিবারিক যোগাযোগ ও ঐতিহ্য তাকে রাজনৈতিক দৃষ্টিতে একটি আলাদা উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।
তিনি ১৯৯৫ সালে বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরপর তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন এবং পরে লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে মেডিসিনে মাস্টার্স (MSc) করেন। তার চিকিৎসক হিসেবে যাত্রা অত্যন্ত সফল ছিল এবং তিনি প্রবাসে থাকাকালীন চিকিৎসা সেবায় ব্যাপক অবদান রাখেন, বিশেষ করে অভিবাসী কমিউনিটিতে। এই অভিজ্ঞতা তাকে দেশের স্বাস্থ্যখাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার জন্য প্রস্তুত করে।
পারিবারিক জীবন: রাজনীতি ঘনিষ্ঠ, কিন্তু নিজে নীরব
১৯৯৪ সালে, তারেক রহমানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তারেক রহমান বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য। ডা. জোবাইদা রহমান শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পুত্রবধূ হিসেবে রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন। তবে, ব্যক্তিগতভাবে কখনো তিনি সরাসরি রাজনীতিতে অংশ নেননি। তাকে বরাবরই এক ধরনের নীরব রাজনৈতিক সহযাত্রী হিসেবেই দেখা গেছে। যদিও তারেক রহমানের সঙ্গে সম্পর্ক তাকে রাজনীতির আড়ালে একটি বিশাল সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে যুক্ত করেছে, তিনি কখনোই প্রকাশ্যে দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেননি।
মামলা, প্রবাস এবং প্রত্যাবর্তন: একটি দীর্ঘ যাত্রা
২০০৮ সালে, দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্ত হন ডা. জোবাইদা রহমান। বিশেষত সম্পদের তথ্য গোপন করার অভিযোগ ওঠে। এই কারণে দীর্ঘ সময় তিনি দেশের বাইরে, বিশেষত যুক্তরাজ্যে অবস্থান করেন। ২০২৩ সালে আদালত তাকে তিন বছরের দণ্ড দেয়, তবে আপিলের মাধ্যমে সেই রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত হয়। ২০০৮ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত তিনি প্রবাসে ছিলেন, এবং দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে কিছুটা দূরে থাকেন। তবে ২০২৫ সালের মে মাসে, প্রায় ১৭ বছর পর তিনি দেশে ফিরে আসেন। ৬ মে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তার প্রত্যাবর্তন একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত হয়ে ওঠে এবং এই ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
রাজনীতিতে আসার সম্ভাবনা: নতুন আশার সঞ্চার
ডা. জোবাইদা রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তন অনেকের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। বিএনপির নেতাকর্মীরা মনে করেন, তার দেশে ফিরে আসা দলের জন্য একটি নতুন সূচনা হতে পারে। এটি দলের জন্য রাজনৈতিকভাবে একটি শক্তিশালী বার্তা, যা দেশের রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এনে দিতে পারে। দলের এক সিনিয়র নেতা মন্তব্য করেন, "তিনি রাজনীতিতে আসলে বিএনপি এক নতুন রূপ পাবে। তার মতো ব্যক্তিত্বই দেশের রাজনীতিতে শুদ্ধতার বার্তা আনতে পারেন।" তবে, এ মুহূর্তে ডা. জোবাইদা রহমান রাজনীতি সম্পর্কে সরাসরি কোন মন্তব্য করেননি, যা তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার প্রতি ইঙ্গিত দেয়।
নারী নেতৃত্বের পথচলা: সম্ভাবনা ও সিদ্ধান্ত
বর্তমানে বাংলাদেশে নারীদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তবে উচ্চস্তরের নেতৃত্বে এখনো কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। ডা. জোবাইদা রহমান সেই শূন্যতা পূর্ণ করতে সক্ষম হবেন কিনা তা নির্ভর করছে তার নিজের সিদ্ধান্তের ওপর। তিনি একজন সুপ্রশিক্ষিত, অভিজ্ঞ এবং আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত ব্যক্তি। তার রাজনৈতিক আগমন বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করতে পারে, বিশেষ করে যখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নতুন নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে।
তবে, তার নীরবতা এখনো একটি বড় প্রশ্নের সৃষ্টি করে—তিনি কি আগামীতে রাজনীতিতে সক্রিয় হতে চান, নাকি তিনি কেবল একজন অভিজ্ঞ সহযাত্রী হিসেবে থাকবেন? সময়ই বলবে, তিনি কিভাবে তার সিদ্ধান্ত নেবেন এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে কী ভূমিকা পালন করবেন।
বর্তমানে তিনি যেভাবে দেশের রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন করেছেন, তা থেকেই বোঝা যায় যে, তার ভবিষ্যৎ পথচলা এখনো অনেকটাই উন্মুক্ত এবং সম্ভাবনাময়।
বিজ্ঞাপন