কাশ্মীরের করুণ বাস্তবতা: “পৃথিবীর স্বর্গ” থেকে নরকের প্রতিচ্ছবি

কাশ্মীরের করুণ বাস্তবতা: “পৃথিবীর স্বর্গ” থেকে নরকের প্রতিচ্ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক, মোরনিউজবিডি
নিজস্ব প্রতিবেদক, মোরনিউজবিডি

প্রকাশিত: ১০:৪৯ ৭ মে ২০২৫

কাশ্মীর—যে ভূখণ্ড একসময় পরিচিত ছিল “পৃথিবীর স্বর্গ” নামে, আজ তা যেন পরিণত হয়েছে এক অনিশ্চয়তা, নিপীড়ন আর নীরব হাহাকারের জ্বলন্ত প্রতিচ্ছবিতে। পেছনে বরফঢাকা পাহাড় আর হিমশীতল হাওয়া বইলেও, বাস্তবতা আজ সেখানে এক ভয়াবহ গুমোট পরিবেশ। প্রতিটি নিশ্বাস যেন ভরে আছে আতঙ্কে, আর প্রতিটি দিন শুরু হয় নতুন আশঙ্কা নিয়ে।

সম্প্রতি পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারতের কথিত “প্রিসিশন স্ট্রাইক”-এর খবর নতুন করে উত্তেজনার আগুনে ঘি ঢেলেছে। পারমাণবিক শক্তিধর এই দুই দেশের এমন সংঘাত শুধু সীমান্তেই থেমে থাকবে না—বিশ্বজুড়ে সৃষ্টি করবে ভয়াবহ মানবিক সংকট। আন্তর্জাতিক মহল উদ্বিগ্ন, কারণ যদি সত্যিকারের যুদ্ধ শুরু হয়, তবে তার পরিণতিতে প্রাণহানির সংখ্যা হতে পারে কোটি ছাড়ানো।

কাশ্মীর সমস্যার শুরুটা ১৯৪৭ সালে, ভারত ও পাকিস্তানের জন্মলগ্নে। জম্মু ও কাশ্মীরের তৎকালীন শাসক হরি সিং ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরই শুরু হয় এই দীর্ঘ দ্বন্দ্ব। সেই থেকে এখন পর্যন্ত তিনটি যুদ্ধ, শত শত সীমান্ত সংঘর্ষ আর অসংখ্য মানুষের মৃত্যু—এই রক্তাক্ত ইতিহাস কেবল বেড়েই চলেছে।

২০১৯ সালের ৫ আগস্ট, কেন্দ্রীয় সরকার সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা তুলে নেয়। এই ঘোষণার পরপরই পুরো উপত্যকাকে ঘিরে ফেলা হয় সেনা ছাউনি দিয়ে। বন্ধ হয়ে যায় মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট। গ্রেপ্তার হন শত শত রাজনৈতিক নেতা, মানবাধিকার কর্মী ও তরুণ সমাজকর্মীরা। সংবাদমাধ্যমে পড়ে যায় সেন্সরের কড়াকড়ি। স্থানীয়দের ভাষায়, “এটা যেন এক অদৃশ্য কারাগার।”

এই পদক্ষেপকে কেন্দ্র সরকার “জাতীয় স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ” বলে ঘোষণা করলেও, কাশ্মীরিদের চোখে তা এক নিরঙ্কুশ দমননীতির বহিঃপ্রকাশ। দিন-রাত নিরাপত্তা বাহিনীর চেকপয়েন্ট, তল্লাশি, আর হঠাৎ তুলে নিয়ে যাওয়া—এটাই এখন কাশ্মীরিদের নিত্যদিনের বাস্তবতা।

জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা কাশ্মীরে নাগরিক অধিকার হরণের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তরুণ জানান, “আমরা বন্দির মতো আছি। প্রতিবাদ করলেই দেশদ্রোহী বলা হয়। কথা বললে বলা হয় জঙ্গি। আমরা শুধু একটু স্বাভাবিক জীবন চাই।”

কাশ্মীরের অর্থনীতির চালিকা শক্তি ছিল পর্যটন, কৃষি ও হস্তশিল্প। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা, ঘন ঘন ইন্টারনেট বন্ধ, আর সেনা-নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে এসব খাত আজ প্রায় মুখ থুবড়ে পড়েছে। করোনা মহামারি যেন তার ওপর শেষ খোঁচাটা দেয়।

পর্যটকদের সংখ্যা কমেছে প্রায় ৭০ শতাংশ। অনেক শিল্পী ও কারিগর কাজ হারিয়ে পরিবার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব ভয়াবহভাবে বেড়েছে, যা এক হতাশাগ্রস্ত প্রজন্ম তৈরি করছে—যাদের স্বপ্ন নেই, নিরাপত্তা নেই, ভবিষ্যৎ নেই।

কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে ভারত ও পাকিস্তান জাতিসংঘে বহুবার অবস্থান নিয়েছে, বিবৃতি দিয়েছে, কিন্তু তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। আন্তর্জাতিক নীরবতা যেন কাশ্মীরিদের এই যন্ত্রণাকে আরও গভীর করে তোলে। একটি গোটা প্রজন্ম বড় হচ্ছে ঘেরাও, গুম, সেনা টহল আর আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে।

এক সময়ের যে ভূখণ্ডে প্রকৃতি উদার হাতে সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছিল, আজ সেখানকার মানুষ বঞ্চিত ন্যূনতম সম্মান, নিরাপত্তা ও শান্তি থেকে। “পৃথিবীর স্বর্গ” শব্দটি আজ যেন কাশ্মীরিদের জীবনে এক নির্মম বিদ্রূপ ছাড়া কিছু নয়।

প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়—এই ভূখণ্ডে আবার কবে ফিরবে হাসিমুখে শিশুরা স্কুলে যাওয়ার দিন? কবে আবার প্রকৃতি ও মানুষ মিলেমিশে গড়বে শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ? আর কবে জাগবে বিশ্ব বিবেক—কাশ্মীরের দীর্ঘশ্বাস শোনার জন্য?

বিজ্ঞাপন