মারা গেলেন বিশ্বের সবচেয়ে ‘দরিদ্র প্রেসিডেন্ট’ হোসে মুজিকা

মারা গেলেন বিশ্বের সবচেয়ে ‘দরিদ্র প্রেসিডেন্ট’ হোসে মুজিকা

অনলাইন ডেস্ক, মোরনিউজবিডি
অনলাইন ডেস্ক, মোরনিউজবিডি

প্রকাশিত: ০৫:৫১ ১৪ মে ২০২৫

বিশ্বজুড়ে বামপন্থীদের কাছে কিংবদন্তি হিসেবে পরিচিত উরুগুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসে ‘পেপে’ মুজিকা আর নেই। খাদ্যনালির ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ এক বছর লড়াই করার পর ৮৯ বছর বয়সে তিনি মারা গেছেন। মে মাসের শুরুতে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে প্যালিয়েটিভ কেয়ারে নেওয়া হয়।

উরুগুয়ের বর্তমান রাষ্ট্রপতি ইয়ামান্দু ওরসি এক শোকবার্তায় বলেন, “গভীর দুঃখের সঙ্গে আমরা আমাদের কমরেড পেপে মুজিকার প্রয়াণের খবর জানাচ্ছি। প্রেসিডেন্ট, রাজনৈতিক কর্মী, পথপ্রদর্শক এবং নেতা—প্রিয় বন্ধু, আপনাকে আমরা খুব মিস করব।” লাতিন আমেরিকার নেতারা ছাড়াও ইউরোপীয় নেতারাও তার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন। বলিভিয়ার ইভো মোরালেস মুজিকার “অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা”র কথা স্মরণ করেন। ব্রাজিল সরকার তাকে “আমাদের সময়ের অন্যতম মানবতাবাদী” হিসেবে অভিহিত করে, আর স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ বলেন, “মুজিকা একটি উন্নত বিশ্বের জন্য বেঁচে ছিলেন।” গুয়াতেমালার প্রেসিডেন্ট বার্নার্ডো আরেভালো তাকে বলেন “নম্রতা এবং মহত্ত্বের উদাহরণ”।

২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট ছিলেন হোসে মুজিকা। কিন্তু তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্নধারার রাষ্ট্রনায়ক। রাষ্ট্রীয় বাসভবনে না থেকে থাকতেন শহরের বাইরে নিজ খামারে। পরতেন সাধারণ স্যান্ডেল, চালাতেন পুরনো ১৯৮৭ সালের ফক্সওয়াগন বিটল, আর নিজের বেতনের প্রায় ৯০ শতাংশই দান করতেন দাতব্য কাজে। বিশ্বজুড়ে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন ‘বিশ্বের দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট’ নামে।

তিনি সবসময় ভোগবাদ ও ভোগ-নির্ভর সমাজের সমালোচনা করতেন। পরিবেশ ও মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে তার বক্তব্য ছিল আন্তরিক ও শক্তিশালী। একবার তিনি বলেন, “আমরা আত্মঘাতী সমাজ তৈরি করেছি। আপনার কাজ করার সময় আছে, কিন্তু বাঁচার সময় নেই।”

তরুণ বয়সে মুজিকা ছিলেন উরুগুয়ের ঐতিহ্যবাহী ন্যাশনাল পার্টির সদস্য। ১৯৬০-এর দশকে তিনি টুপামারোস ন্যাশনাল লিবারেশন মুভমেন্ট (এমএলএন-টি) গঠনে সহায়তা করেন, যা ছিল একটি বামপন্থী শহুরে গেরিলা সংগঠন। কিউবার বিপ্লব এবং আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্র দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তারা উরুগুয়ের সরকারের বিরুদ্ধে গোপন প্রতিরোধ শুরু করে।

এই সময় মুজিকাকে চারবার গ্রেফতার করা হয়। ১৯৭০ সালে পুলিশের গুলিতে ছয়বার বিদ্ধ হন তিনি, কিন্তু অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। তিনি দুইবার কারাগার থেকে পালান। একবার ১০৫ বন্দীর সঙ্গে টানেলের মাধ্যমে পালিয়ে যান, যা উরুগুয়ের ইতিহাসে অন্যতম বড় পালানোর ঘটনা। সামরিক সরকারের সময়ে তাকে ‘নয় জিম্মি’র একজন হিসেবে রাখা হয়, যাদের হত্যা করার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। তিনি কারাগারে মোট ১৪ বছরেরও বেশি সময় কাটান, যার বড় অংশই ছিল নিঃসঙ্গ নির্যাতনমূলক অবস্থায়।

১৯৮৫ সালে উরুগুয়ে গণতন্ত্রে ফিরে এলে তিনি মুক্তি পান। পরবর্তীতে তিনি কৃষিমন্ত্রী হন এবং পরে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি সহজ-সরল জীবনযাপন করতেন, ভোগবাদবিরোধী অবস্থান নিতেন এবং সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পক্ষে কাজ করতেন।

২০২০ সালে তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নেন। এরপরেও তার ছোট খামারটি বামপন্থী রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও ভক্তদের কাছে তীর্থস্থানে পরিণত হয়। ২০২৪ সালের মে মাসে তার ক্যানসার ধরা পড়ে। মৃত্যুর আগে তিনি তার খামারেই সমাহিত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, যেখানে তার প্রিয় পোষা কুকুরের কবরও রয়েছে।

তার স্ত্রী লুসিয়া তোপোলানস্কি—একসময়কার গেরিলা সহযোদ্ধা—এখনো জীবিত আছেন। তাদের কোনো সন্তান ছিল না। হোসে মুজিকার জীবন শুধুই রাজনৈতিক ইতিহাস নয়, এটি আদর্শ, ত্যাগ, এবং মানবিকতার এক চিরন্তন উদাহরণ।

বিজ্ঞাপন