বৃহস্পতিবার , ১৫ মে, ২০২৫ | ১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ০৯:৪৭ ১৫ মে ২০২৫
এক সময়ের দরিদ্র বাউলশিল্পী মমতাজ বেগম গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। বাবা মধু বয়াতির সঙ্গে পথে পথে ঘুরে বিভিন্ন মাজারে গান করতেন তিনি। ১৯৯৯ সালে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’-তে গান গেয়ে আলোচনায় আসেন। পরে দ্বিতীয় স্বামী রমজানের হাত ধরে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন এবং ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের বিতর্কিত সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে মানিকগঞ্জ-২ আসনের এমপি নির্বাচিত হন।
সংসদ সদস্য হওয়ার পর থেকেই মমতাজের জীবনে আসে বিশাল পরিবর্তন। এক সময়ের অনাহারে দিন কাটানো মানুষটি পরিণত হন হাজার কোটি টাকার মালিক হিসেবে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঢাকায় ও নিজ এলাকায় গড়ে তুলেছেন বিলাসবহুল বাড়ি, রেস্টুরেন্ট, কোল্ড স্টোরেজ, বাউল কমপ্লেক্স, ডুপ্লেক্স বাড়ি—এমনকি কানাডাতেও রয়েছে তার স্থাবর সম্পদ। স্থানীয়দের ভাষায়, মানিকগঞ্জের সিংগাইর ও হরিরামপুর উপজেলা কার্যত মমতাজের রাজত্বে পরিণত হয়েছিল, যেখানে তার হুকুমই ছিল আইন।
নিজ নির্বাচনী এলাকায় প্রভাব বিস্তারের জন্য গড়ে তোলেন সশস্ত্র ‘হেলমেট বাহিনী’। এই বাহিনীর মাধ্যমে তিনি টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, জমি দখল, সরকারি চাকরি বিক্রি এবং প্রশাসনিক কাজে প্রভাব বিস্তার করতেন। পুলিশ প্রশাসনও ছিল তার প্রভাবের বাইরে নয়। কেউ তার আদেশ না মানলে চাকরি বা রাজনৈতিক পদ হারাতে হতো। দলীয় রাজনীতির ক্ষেত্রেও নিজের প্রভাব খাটিয়ে সিংগাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হন তিনি, আর সাধারণ সম্পাদক বানান নিজের প্রথম স্বামীর ভাগ্নে শহীদুর রহমান শহীদকে।
মমতাজ পরিবারের সদস্যদেরও রাজনীতিতে আনেন। তার সৎ ছেলে আবু নাঈম বাশারকে ভোট জালিয়াতির মাধ্যমে সিংগাইর পৌরসভার মেয়র বানান। ছোট মেয়ে রাইসা রোজ উপজেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি, ভাগ্নে ফিরোজ কবির ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি এবং সৎ বোন একজন ইউপি সদস্য। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের স্থানীয় প্রতিটি কমিটিতেই তার আত্মীয়স্বজন ও ঘনিষ্ঠদের বসান।
দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতার অপব্যবহারে বিরোধিতা গড়ে উঠলেও মমতাজ ও তার বাহিনীর দখলদারিত্ব এতটাই শক্ত ছিল যে কেউ প্রকাশ্যে কথা বলার সাহস পেত না। হরিরামপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান দেওয়ান সাইদুর রহমান ছিলেন তার প্রধান রাজনৈতিক শত্রু। ভাগ-বাটোয়ারা ও আধিপত্য নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল সর্বদা।
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে মমতাজের নামে মাত্র ৪৮ শতাংশ পৈত্রিক জমি ছিল। কিন্তু পরবর্তী ১৬ বছরে তিনি হয়ে ওঠেন শত শত বিঘা জমির মালিক। অনুসন্ধানে জানা যায়, সিংগাইরের হেমায়েতপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে ১৩ একর জমির উপর গড়ে তুলেছেন 'মধুর আড্ডা' রেস্টুরেন্ট, কোল্ড স্টোরেজ, দোতলা ও চারতলা ভবন, বাংলো বাড়ি এবং অন্যান্য স্থাপনা।
আওয়ামী লীগ সরকারের ভাঙনের পর গত ৯ মাস মমতাজ আত্মগোপনে ছিলেন। অবশেষে ২০২৫ সালের ১২ মে রাতে ঢাকার ধানমন্ডির একটি বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে মানিকগঞ্জ ও ঢাকায় অন্তত ৬টি মামলা রয়েছে।
বিজ্ঞাপন